কাজী নজরুল ইসলাম ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে, ২৪শে মে ১৮৯৯ সালে ভারতের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর লেখনীতে লুকিয়ে ছিল সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষের মুক্তির সংগ্রামের বাণী। তাঁর কিছু কিছু লেখনীতে তা প্রকাশ পেয়েছে সাবলীলভাবে। যা জন্য তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যে ধূমকেতুর মতাে তার আবির্ভাব। অন্যায় অবিচার, জুলুম ও শােষণের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে প্রচণ্ড বিদ্রোহ। তিনিই শুনিয়েছিলেন সংগ্রাম ও বিপ্লবের কথা। জাতিকে দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্ন।

কাজী নজরুলের প্রেমের কবিতা – নজরুলের সেরা ৫ কবিতা
০১) আমার কালো মেয়ে
আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে
কে দিয়েছে গালি
তারে কে দিয়েছে গালি
রাগ করে সে সারা গায়ে
মেখেছে তাই কালি।
যখন রাগ করে মোর অভিমানী মেয়ে
আরো মধুর লাগে তাহার হাসিমুখের চেয়ে
কে কালো দেউল করে আলো
অনুরাগের প্রদীপ জ্বালি।
পরেনি সে বসনভূষণ, বাঁধেনি সে কেশ
তারি কাছে হার মানে রে ভুবনমোহন বেশ।
রাগিয়ে তারে কাঁদি যখন দুখে
দয়াময়ী মেয়ে আমার ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে
আমার রাগী মেয়ে, তাই তারে দিই
জবা ফুলের ডালি।।
০২) আমার কোন কুলে আজ
আমার কোন কুলে আজ ভিড়লো তরী
এ কোন সোনার গাঁয়?
আমার ভাটির তরী আবার কেন
উজান যেতে চায়?
দুখেরে কান্ডারী করি
আমি ভাসিয়েছিলাম ভাঙ্গা তরী
তুমি ডাক দিলে কি স্বপন পরী
নয়ন ইশারায় গো?
নিভিয়ে দিয়ে ঘরের বাতি
ডেকেছিলে ঝড়ের রাতি
কে এলে মোর সুরের সাথি
গানের কিনারায়?
সোনার দেশের সোনার মেয়ে
ওগো হবে কি মোর তরীর নেয়ে
এবার ভাঙ্গা তরী চল বেয়ে
রাঙা অলকায়।।
০৩) আপন –পিয়াসী
আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনায়,
আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি
আমারি তিয়াসী বাসনায়।।
আমারই মনের তৃষিত আকাশে
কাঁদে সে চাতক আকুল পিয়াসে,
কভু সে চকোর সুধা-চোর আসে
নিশীথে স্বপনে জোছনায়।।
আমার মনের পিয়াল তমালে হেরি তারে স্নেহ-মেঘ-শ্যাম,
অশনি-আলোকে হেরি তারে থির-বিজুলি-উজল অভিরাম।।
আমারই রচিত কাননে বসিয়া
পরানু পিয়ারে মালিকা রচিয়া,
সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া,
আপনারি গলে দোলে হায়।।
কাজী নজরুলের প্রেমের কবিতা – নজরুলের সেরা ৫ কবিতা
০৪) বেদনা-মণি
একটি শুধু বেদনা মানিক আমার মনের মণিকোঠায়
সেই তো আমার বিজন ঘরে দুঃখ রাতের আঁধার টুটায়।
সেই মানিকের রক্ত-আলো
ভুলাল মোর মন ভুলাল গো।
সেই মানিকের করুণ কিরণ আমার বুকে মুখে লুটায়।
আজ রিক্ত আমি কান্না হাসির দাবি দাওয়ার বাঁধন ছিঁড়ে
ওই বেদনা-মণির শিখার মায়াই রইল একা জীবন ঘিরে।
এ কালফণী অনেক খুঁজি
পেয়েছে ওই একটি পুঁজি গো!
আমার চোখের জলে ওই মণিদীপ আগুন হাসির ফিনিক ফোটায়।
০৫) ব্যথা-নিশীথ
এই নীরব নিশীথ রাতে
শুধু জল আসে আঁখিপাতে।
কেন কি কথা স্মরণে রাজে?
বুকে কার হতাদর বাজে?
কোন্ ক্রন্দন হিয়া-মাঝে
ওঠে গুমরি’ ব্যর্থতাতে
আর জল ভরে আঁখি-পাতে।।
মম বর্থ জীবন-বেদনা
এই নিশীথে লুকাতে নারি,
তাই গোপনে একাকী শয়নে
শুধু নয়নে উথলে বারি।
ছিল সেদিনো এমনি নিশা,
বুকে জেগেছিল শত তৃষা
তারি ব্যর্থ নিশাস মিশা
ওই শিথিল শেফালিকাতে
আর পূরবীতে বেদনাতে।।
কাজী নজরুলের প্রেমের কবিতা – নজরুলের সেরা ৫ কবিতা
জন্ম ও শৈশবকাল: পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। দাদার নাম কাজী আমিন উল্লাহ। শৈশবে মাত্র আট বছর বয়সে বাবাকে হারান। পিতার মৃত্যুর পর নজরুলের পরিবারে নেমে আসে চরম আর্থিক অভাব-অনটন দুঃখ দারিদ্র। ফলে শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্থ। হয়। তখন থেকেই জীবিকা নির্বাহের জন্য তাকে কাজ করতে হয়। গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর কিছুদিন স্থানীয় মাজারে খাদেম, মসজিদে ইমামতি ও মোল্লাগিরি করেন।
নজরুলের জন্মের পূর্বে তার একাধিক ভাইবোন মারা যায়। এজন্য ছোটবেলায় তাঁকে তাঁর পিতামাতা “দুখু মিয়া” বলে ডাকতেন। মাদ্রাসায় কাজ করার সুবাদে নজরুলের ভিতর ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। খুব অল্প বয়সে তাঁর কবিত্বশক্তির প্রকাশ পায়। তিনি মুখে মুখে ছন্দ মিলিয়ে পদ্য রচনা করতে পারতেন। গ্রামের লেটোর দলে যোগ দিয়ে নজরুল গান গেয়েছেন, অনেক পালাগান রচনা করেছেন।
পারিবারিক জীবন: নার্গিস আসার খানম কবি নজরুল ইসলামের প্রথম স্ত্রী ছিলেন। ১৯২১ সালে কবির সাথে নার্গিসের বিয়ের দিন ধার্য হয়। বিয়ে সম্পন্ন হলেও কাবিনে ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলে নজরুল বাসর সম্পন্ন না করে নার্গিসকে রেখে দৌলতপুর ত্যাগ করে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন। আলী আকবর খানের সাথে তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে। এরপর তাদের প্রনয় হয়। ২৫ এপ্রিল ১৯২৪ ( ১২ বৈশাখ ১৩৩১) কবি নজরুলের সাথে প্রমীলা দেবীর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এটি ছিল কবি নজরুলের দ্বিতীয় বিয়ে। বিয়েতে কাজী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্যিক মইনুদ্দিন হোসেন। সাক্ষী হিসাবে কুমিল্লার আবেদনকারী আবদুস সালাম, সাংবাদিক মোঃ ওয়াজেদ আলী এবং কবি খান মুহাম্মদ মাইউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের পরে প্রমিলার নাম দেওয়া হয়েছিল “আশালতা”। এরপর প্রায় ১৫ বছর পরে নজরুলের সাথে নার্গিসের দেখা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
সৈনিক জীবন: ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠে সমগ্র ইউরোপে। নজরুল তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। যুদ্ধের আহ্বান শুনে স্কুল থেকে পালিয়ে তিনি ৪৯ নম্বর বাঙ্গালি পল্টনে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে চলে যান করাচি। নিজ দক্ষতায় অল্পদিনের মধ্যে নজরুল হাবিলদার পদে উন্নীত হন। সেনা শিবিরে ব্যস্ততার মাঝেও তিনি সাহিত্য চর্চার চালিয়ে যান। করাচি থেকেই তিনি কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠান। তার প্রথম লেখা বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী নামে একটি গল্প এবং প্রথম কবিতা মুক্তি। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি।(৪) ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এরপর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।
জগত বিখ্যাত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেরা ৫ কবিতা